বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি!! আসলেই কি দরকারি??

এই লেখাটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে। আশা রাখছি পড়বেন।

আচ্ছা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা যে লাল, নীল, সাদা, গোলাপী,  আরো কি কি রং এর রাজনীতি করে; এই রাজনীতি টা আসলে কি কাজে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ে? বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অবকাঠামোগত উন্নয়নে এই রাজনীতি ভূমিকা রাখে? একাডেমিক কার্যক্রমে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো পরিবেশ রক্ষায়? কোনটাতে কাজে আসে? এনিথিং? 

আমি এমন অনেক শিক্ষকেকে চিনি, জানি যারা তাদের থিসিস স্টুডেন্টকে ঠিকমতো সময় দেয়না। দায়সারেভাবে যা পারে করে নিয়ে আসো টাইপ। তারপর ডিফেন্স টাইম নিয়ে ঘুরাবে। প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে যদি খোঁজ করা  যায় তাহলে দেখা যাবে গড়ে ২/৩ জন বা তারও কম শিক্ষক ভালো থিসিস বোঝেন এবং থিসিস স্টুডেন্টকে সময় দেন।

আর ক্লাশের টাইম দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টুডেন্টদের বসিয়ে রাখাকে তো অনেকে নিজের জন্মগত অধিকার মনে করেন।দুই তিনটা ক্লাশ নিয়ে কোর্স শেষ করে ফেলা শিক্ষকও দেখেছি।  এমন শিক্ষকও পেয়েছি যিনি মিডটার্ম পরীক্ষার ডেট দিয়ে সেই ডেট তিনবার পাল্টিয়ে পরীক্ষা নিয়েছেন এবং একই কাজ ৬ বছর ধরে রিপিট হয়েছে। আই সে এগেইন ৬ বছর! 

শিক্ষকদের প্রধান কাজ ২ টি। পড়ানো এবং গবেষণা। কিন্তু তারা প্রধান দুটি কাজ রেখে বাকি সব অকাজ নিয়ে ব্যস্ত।  রাজনীতি করবেন নাকি গবেষণা করে আর্টিকেল প্রকাশ করবে, নাকি পড়াবেন?! প্রথমটা করে বাকি দুটির দিকে আর নজর থাকেনা। শিক্ষক রাজনীতি কি তাহলে শুধু তাদের পদোন্নতি আর পদের জন্য নয় কি?

১২ নভেম্বর ২০১৯,  BBC News বাংলা অনলাইন পোর্টালে "বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা: শিক্ষকদের রঙের রাজনীতি কাদের স্বার্থে?" এই নামে একটি সংবাদে শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, "এখন দলভিত্তিক যে শিক্ষক রাজনীতি সেখানে আদর্শই মুখ্য নয়, বরং লোভের সংস্কৃতিটাই মুখ্য। তিনি বলেছেন, '৮০'র দশকেও আমরা দেখেছি শিক্ষকদের মধ্যে আদর্শিক ভিন্নতা এবং ব্যবধান ছিলো। কিন্তু সেই রাজনীতি তখন দলীয় রাজনীতি ছিলো না। সেটা ছিলো গণমানুষের কল্যাণে, শিক্ষার কল্যাণে।" বাংলাভাষায় একটি প্রবাদ আছে। এ প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘সেই রামও নাই, সেই অযোধ্যাও নাই।’  পাঠদান ক্যাটাগরিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্ত স্কোর ১০০'র মধ্যে ১৬ আর গবেষণায় ৮.৮।  তিনি আরো বলেন, 'শিক্ষকদের মৌলিক কাজ দুটি। পড়ানো এবং গবেষণা।"

২৮ জানুয়ারি ২০২১,যুগান্তর "শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আত্মানুসন্ধান" এই লেখাটিতে উঠে এসেছে, সিনিয়র শিক্ষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা অতীতেও শিক্ষকদের ছিল। কিন্তু এখনকার মতো ভয়াবহ অবস্থা অতীতে কখনো হয়নি।"

প্রথম আলোর, ২৭ আগস্ট ২০২৩ "ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘মুক্তি’ দেবে কে" এই লেখাতে উঠে এসেছে, পড়াশোনা, জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, উদ্ভাবন—এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রের বহির্ভূত হয়ে যাচ্ছে। নামমাত্র ওপরে ওপরে শিক্ষার হালকা-পাতলা প্রলেপ আছে,ভেতরে–ভেতরে অপরাজনীতি, দলাদলি, দলান্ধতা, অনিয়ম, দুর্নীতি চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক এখন শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে যান না, দলবাজি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি পেয়েছেন বলে কেবল ক্লাসে আসা-যাওয়া করেন। আর শিক্ষার্থীরাও উপস্থিতি নম্বরের জন্য কেবল ক্লাসে আসা-যাওয়া করেন। শিক্ষকেরা এখন গবেষণা করেন না, পদোন্নতির জন্য দল চর্চা করেন। নিজের সমর্থিত রাজনৈতিক দল দেশের জনগণের ওপর অন্যায়, অত্যাচার করলেও তাঁরা সুখের হাসি হেসে দলের গুণকীর্তন করেন।

'বাঁধ ভাঙার আওয়াজ' অনলাইন পোর্টাল ০১ লা আগস্ট, ২০১৮  সালে "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় - সাদা আর নীল বিষের আঁধার (শিক্ষক রাজনীতি, শিক্ষার পরিবেশ, গবেষণা ও নিয়োগ)" এই লেখাতে উঠে এসেছে, শিক্ষা, গবেষণা, পাঠদান, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে আরো উৎকর্ষ সাধনের পথ ছেড়ে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি এবং ব্যক্তিগত পদ-পদবী আর দলাদলির স্বার্থে শিক্ষকরা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছেন।

একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদায়ন ও মর্যাদা যখন রাজনৈতিক বিবেচনায় হয় তখন সেখানে গবেষণা ও সুষ্ঠু পাঠদান মুখ্য বিষয় থাকে না। আর এটাই হচ্ছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ধ্বংসের সবচেয়ে সহজ পথ।

লন্ডনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে গিয়ে দেখেছি কে ভিসি, কে ডিন, কে প্রক্টর কেউ চেনে না। আর চেনার প্রয়োজনও নেই। শিক্ষকদের এত এত পদ-পদবীও নাই। থাকলে গবেষণা বাদ দিয়ে শিক্ষকরা এসব পদ নেবেন না বলে আমার বিশ্বাস। নেই রাজনীতির কোন চর্চা। নেই প্রতিহিংসা, পদ-পদবীর দৌড়ঝাপ। সেখানে ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলেও কেউ এর অপব্যবহার করে না। ছাত্রীরা নিরাপত্তার অভাববোধ করে না!

একটি শিশুর হাতে বিপজ্জনক আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেয়া আর শিক্ষকদের মাথায় রাজনীতির প্যাচ ঢুকিয়ে দেওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উভয়ই ধ্বংস ডেকে আনে, সৃষ্টি নয়। একজন শিক্ষককে আমরা রাজনীতিবিদ নয়, শুধুমাত্র শিক্ষক ও গবেষক হিসাবে দেখতে চাই। শিক্ষকদের রাজনীতি নয়, শিক্ষানীতির মধ্যে থাকতে হবে। "

এত কথা বলার একটায় কারণ, ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করা হোক। যেই রাজনীতি শিক্ষার্থীদের জন্য না, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য না, সেই দলাদলির রাজনীতি দিয়ে আমরা কি করবো?

আপনারা ক্লাশে মনোযোগী হোন, গবেষণাতে মনোযোগী হোন। আশা রাখছি, শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে সোচ্চার হবেন।
 

লিখেছেনঃ সাদিয়া সুলতানা (৮ম ব্যাচ),
অর্থনীতি বিভাগ, 
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।

Post a Comment

0 Comments